কৃষ্ণকুমারী নাটকে মোট কয়টি গান আছে ? গানগুলি উল্লেখ করে নাট্যকাহিনির অগ্রগতিতে গানগুলির গুরুত্ব উল্লেখ কর।
কৃষ্ণকুমারী নাটকে মোট গান আছে পাঁচটা। মানুষের মুখের ভাষা সীমাবদ্ধ, অন্তরের ভাব অসীম। এই বৃহৎ ব্যাকুল ভাবকে সবসময় সীমাবদ্ধতায় প্রকাশ করা যায় না বলেই প্রয়োজন হয় সুরের। সুর অনেক সময়ই ভুলিয়ে দেয় আমাদের অতীত রূঢ় বাস্তব চেতনা। মধুসূদন তাঁর নাটকে সংগীতকে ঠিক কোন অর্থে ব্যবহার করেছেন তা আমাদের বিচার করে দেখতে হবে।
বাংলা নাটকের প্রথমপর্বে গান ব্যবহৃত হত মূলত রঙ্গরস সৃষ্টির জন্যে। গ্রীক নাটকের প্রথমে ও শেষে থাকত কোরাস। সংস্কৃত নাটকের প্রথমে থাকত নান্দী শ্লোক। বাংলা নাটকেও প্রথমদিকে গানের ব্যবহার ছিল তবে নাট্যকাররা নাটকে গান ব্যবহার করতেন রঙ্গরস সৃষ্টির জন্য।
কৃষ্ণকুমারী নাটকে গানগুলির গুরুত্ব
মধুসদন সংগীতজ্ঞ ছিলেন না। কিন্তু তার প্রথম নাটক শর্মিষ্ঠাতে তিনি গান সংযোজন করেছিলেন। আমরা জানি যে শর্মিষ্ঠার গানগুলো লিখেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ ও যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর। লক্ষ্যণীয় যে নাটক লিখেছিলেন একজন গান লিখেছিলেন অন্যজন। গানগুলি নাটকে সংযোজিত হয়েছে। হয়তো গানগুলি স্থাপন করার জন্য নাট্যকারকে নাটকের অদলবদল করতে হয়েছে। হয়তো নাটকের পাণ্ডুলিপি পড়ে পরে গানগুলি রচনা করতে হয়েছে। এসম্বন্ধে প্রকৃত তত্ত্ব আমাদের জানা নেই। কিন্তু স্বীকার করতে হয় যে, এভাবে গান ব্যবহারের মধ্যে একটা কৃত্রিমতা আছে। কেননা অন্তর প্রেরণার গভীর তাগিদে গানগুলি রচিত হয়নি। আমাদের তাই লক্ষ্য করতে হবে যে গানগুলি প্রয়োগের ক্ষেত্রে মধুসূদন সেই কৃত্রিমতাকে কতটুকু পরিহার করতে পেরেছেন।
Read more কৃষ্ণকুমারী চরিত্র অথবা কৃষ্ণকুমারী চরিত্রের ট্র্যাজেডি আলোচনা কর।
‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকে মোটগান আছে পাঁচটি। প্রথম গানটি আছে দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে। দ্বিতীয় গানটি আছে দ্বিতীয় অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্যে। তৃতীয় গানটি আছে তৃতীয় অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে। চতুর্থ গানটি আছে তৃতীয় অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্যে। পঞ্চম গানটি আছে চতুর্থ অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে। প্রথম ও পঞ্চম অঙ্কে কোন গান নেই। প্রথম তিনটি গান কৃষ্ণকুমারীর গাওয়া। চতুর্থ গানটি কে গেয়েছে তা নির্দিষ্ট করে বলা নেই। পঞ্চম গানটি গাওয়া হয়েছে বিলাসবতীর অন্তরপুরে। পাঁচটি গানেরই সুরের উল্লেখ আছে। তবে পাঁচটি গানই গাওয়া হয়েছে নেপথ্য থেকে। প্রশ্ন হল গানগুলির সুরের সঙ্গে সময় ও পরিবেশের সঙ্গতী ঘটেছে কী না ? এবং গানগুলি নেপথ্য থেকে গাওয়া হল কেন ?
কৃষ্ণকুমারীর গানগুলি নেপথ্য থেকে গাওয়ার একটি প্রয়োগগত তাৎপর্য আছে। আগেকার দিনে বেশির ভাগ সময় নারী চরিত্রে অভিনয় করতো পুরুষেরা। মহিলা অভিনেত্রী যদিও কদাচিৎ মিলত কিন্তু একই সঙ্গে গায়িকা ও নায়িকা অভিনেত্রী পাওয়া যেত না। এছাড়াও গানগুলি নেপথ্য থেকে গাওয়া হলে সুবিধা ছিল এই যে বাহির থেকে গানগুলি অন্য কেউ গেয়ে দিতে পারত। তবে প্রয়োগগত এই প্রয়োজন ছাড়াও গানগুলিকে নেপথ্যে রাখার একটি সাহিত্যিকগত তাৎপর্য আছে।
Read also ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকেও মধুসূদন উপকাহিনির সংযোজন করেছেন তা আলোচনা করো
- কৃষ্ণকুমারীর প্রথম গান – ‘শুনিয়ে মোহন মুরলী গান।’
- দ্বিতীয় গান – ‘অসুখী ভ্রমর দলে/নলিনী-মলিনী ক্রমে/বিষাদে শলিলে’
- তৃতীয় গান – ‘তারে না হেরে আঁখি জুড়ে।’
এই তিনটি গান প্রেমের গান। প্রথম গানটিতে প্রকাশ পেয়েছে বিরহ বেদনা। যদিও কৃষ্ণকুমারীর সামনে তখন কোন নির্দিষ্ট পুরুষ আসেনি। অথচ ভালবাসার জন্য তার মন উতাল পাতাল হয়ে উঠেছে। সেই বেদনা প্রকাশ পেয়েছে তার গানে। মঞ্চে বসে তার মা বাবা এই বিরহের গানটি শুনেই তারা কৃষ্ণকুমারীকে বিয়ে দিতে সচেষ্ট হয়েছেন। নাট্যকাহিনির বীজ স্থাপন ঘটেছে এই গানটিতে। দ্বিতীয় গানটিতেও বিরহের আত্মনিঃশ্বাস আছে। কৃষ্ণকুমারীকে বিয়ের জন্য মহারাজ জগৎসিংহ দূত পাঠিয়েছেন।
কিন্তু কৃষ্ণকুমারী ততদিনে মানসিংহের প্রতিকৃতি দেখেছেন। তার সামনে তখন একজন নির্দিষ্ট পুরুষ এসে দাড়িয়েছে। তাই দ্বিতীয় গানটিতে বিরহ নির্দিষ্ট লক্ষ্যের অভিমুখে চালিত হয়েছে। প্রথম গানটিতে ছিল প্রেমের জন্য ব্যাকুলতা। দ্বিতীয় গানটিতে ব্যাকুলতা প্রেমিকের জন্য। আর তৃতীয় গানটিতে অনায়াসেই প্রকাশ পেয়েছে দেহকাতরতা। এখানে বলার কথা যে কৃষ্ণকুমারীর এই গানগুলি বা গানগুলির মধ্যদিয়ে ফুটে উঠা মনোভাব যেহেতু তার বাবা-মার উদ্দেশ্যে বলা সেহেতু গানগুলিকে নেপথ্য থেকে গাওয়া এবং পরোক্ষভাবে বলা হয়েছে। ফলে এটুকু বলা যায় গানগুলি যারই লেখা হোক না কেন স্বীকার করতে হয় যে উপস্থাপনের দিক থেকে গানগুলি সার্থক।
চতুর্থ গানটির তেমন কোন শিল্প সার্থকতা নেই। ‘রাত্রি যে প্রভাত হল’ এই সংলাপের পর ‘যাইতেছে যামিনী. নালিনী।’ গানটি অর্থহীন। পঞ্চম গান – ‘মনে বুঝে দেখনা/ এমান সহজে যাবে না।’ এই গানটি মান ভঞ্জনের গান। গানটির সুর ও ভাষা বারবণীতার গৃহে সম্পূর্ণ উপযুক্ত। কিন্তু বিলাসবতী বৃত্তিতে বারবণীতা হলেও স্বভাবে প্রেমিকা। তাই এই সমস্ত সামান্য ত্রুটি বিচ্যুতি থাকা সত্বেও স্বীকার করতে হয় যে কৃষ্ণকুমারী নাটকের গানগুলি নাটকের মূল ভাবকে বিকশিত করতে সাহায্য করেছে।
সুতরাং কৃষ্ণকুমারী নাটকের গানগুলি ভাব, ভাষা ও রসের দিক থেকে মোটামুটি সার্থক হয়েছে বলা চলে। কেননা গানগুলির মধ্যে যেমন ভাবের চমৎকারিত্ব আছে, তেমনি আছে ভাষার গতিময় মূৰ্চ্ছনা, সেইসঙ্গে চরিত্রানুপ সংহত ও সংযত প্রয়োগ কৌশলের অভিনবত্ব যা পাঠক ও দর্শকের রসাস্বাদনের সমর্থক।