কৃষ্ণকুমারী চরিত্র অথবা কৃষ্ণকুমারী চরিত্রের ট্র্যাজেডি আলোচনা কর।
গ্রীক নাটক কাহিনি প্রধান। তাই অ্যারিষ্টটল কাহিনিকে ট্র্যাজেডির শ্রেষ্ঠ অঙ্গ বলেছেন। আধুনিককালে নাটকের কাহিনির স্থান গ্রহণ করেছে চরিত্র। ফলে সেক্সপীয়রের নাটকগুলি চরিত্র প্রধান। মধুসূদন গ্রীক ও সেক্সপীয়রের আদর্শকে গ্রহণ করেছেন তার নাটকে কিন্তু মধুসূদনের অঙ্কিত চরিত্রগুলির মধ্যে ‘ট্র্যাজিক দ্বন্দ্ব নেই। ভীমসিংহ, জগৎ সিংহ, কৃষ্ণকুমারী প্রভৃতি প্রধান চরিত্রগুলির মধ্যে করুণ রসের আভাস থাকলেও তীব্র ট্র্যাজিক অন্তর্দ্বন্দ্ব নেই।
নাট্যচরিত্রে ট্র্যাজেডি আসে মূলত দুটি প্রবৃত্তির দ্বন্দ্বে – আন্ত্যর্থক ও নৈঞার্থক চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ্ব হয় তখনই যখন স্থায়ী ভাববদ্ধ ও উপস্থায়ী ভাববদ্ধের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকের কৃষ্ণকুমারী চরিত্রে এই জাতীয় কোন দ্বন্দ্ব নেই। ভীমসিংহ তার একমাত্র কন্যা স্নেহের নয়নমণি কৃষ্ণকুমারীকে হত্যার আদেশ দিয়েছেন নিরুপায় হয়ে। কেননা কৃষ্ণকুমারী কেন্দ্রিক দ্বন্দ্বে মানসিংহ ও জগৎ সিংহের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মত লোকবল, অর্থবল ও ব্যক্তিত্ব কিছুই ভীমসিংহের ছিলনা। কৃষ্ণকুমারীকে হত্যার আদেশ দিয়ে ভীমসিংহ বেদনায় ভেঙ্গে পড়েছেন একথা সত্য কিন্তু তার মধ্যে তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা যায়নি।
Read more ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকেও মধুসূদন উপকাহিনির সংযোজন করেছেন তা আলোচনা করো
অন্যদিকে জগত সিংহ ও মানসিংহের কূট চালের কাছে অপদস্ত হয়ে কৃষ্ণকুমারীকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছে। ফলে জগৎ সিংহ ও মানসিংহের মনে কৃষ্ণার জন্য বিন্দুমাত্র অন্তর্যন্ত্রণা ছিল না। আসলে জগৎসিংহ ও মানসিংহ, ধনদাস ও মদনিকার চক্রান্তের শিকার হয়ে কৃষ্ণকুমারীকে বিয়ে করতে চেয়েছে এইমাত্র, কৃষ্ণাকে ভালবেসে নয়। ফলে উভয়ের মনে কৃষ্ণার মৃত্যুর জন্য বিশেষ কোন অনুতাপ বা লজ্জাবোধ ছিল না। এইক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম কৃষ্ণকুমারীর কাকা বলেন্দ্র সিংহ। কেননা, কৃষ্ণা হত্যার দায়িত্ব নিয়ে ও কন্যাস্নেহে তিনি বারবার আবেগ তাড়িত হয়ে ফিরে এসেছেন। কারণ কৃষ্ণার প্রতি ছিল তার ঐকান্তিক স্নেহ ও ভালবাসা।
ফলে ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকের বিশেষ কোন চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকাশ পায়নি। অথচ আমরা জানি দুঃখের বিরুদ্ধে যে লড়াই করতে পারে, পরাজয় অবশ্যম্ভাবী জেনেও যে ভাগ্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সেই চরিত্রই যথার্থ ট্র্যাজিক চরিত্র হয়ে উঠে। অথচ এই ধরণের দুর্জয় ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন চরিত্র কৃষ্ণকুমারী নাটকে নেই।
কৃষ্ণকুমারী চরিত্র
কৃষ্ণকুমারী চরিত্রটি ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকের নায়িকা। পঞ্চদশ বর্ষীয়া কৃষ্ণকুমারী সৌন্দর্যের লাবণ্যে অতুলনীয়া। তপস্বিনী পর্যন্ত কৃষ্ণকুমারীর রূপে মুগ্ধা। জগৎ সিংহের চোখেও কৃষ্ণকুমারী একটি পরম বিস্ময় ভগবতী। এই কৃষ্ণকুমারীকে উমা ও মন্দাকিনীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। কৃষ্ণকুমারী যখন গান করে তখন মনে হয় আকাশ থেকে যেন সুধা বর্ষণ হচ্ছে। থচ এইরূপ ও গুণের জন্যই কৃষ্ণকুমারীর জীবনে সর্বনাশ নেমে এসেছে। একই সঙ্গে দুই রাজা কৃষ্ণকুমারীকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে এবং এই বিয়েকে কেন্দ্র করেই ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকে ট্র্যাজেডির বীজ রোপন করা হয়েছে। সুতরাং কৃষ্ণকুমারী চরিত্রের বিশেষ কোন দ্বন্দ্ব নেই।
কৃষ্ণকুমারীকে কেন্দ্র যখন সমস্ত রাজপরিবারে দুর্যোগের কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। দেশ জাতি গভীর সঙ্কটের মধ্যে নিমজ্জিত হয়েছে তখনও কৃষ্ণকুমারী স্বপ্নে পদ্মিনীর মূর্তি দর্শন করেছে এবং জেনেছে রাজ্যের কল্যাণের জন্য তার মৃত্যুর প্রয়োজন। কিন্তু বলা বাহুল্য কৃষ্ণকুমারী আত্ম উৎসর্গের জন্য (আত্মহত্যা) প্রস্তুতি নিয়েছেন কিন্তু নাট্যকার কৃষ্ণকুমারীর মানস সচেতনাকে পরিবর্তনের জন্য কোন চেষ্টাই করেননি। ফলে মনস্তাত্বিকতার অভাবে কৃষ্ণকুমারী চরিত্রের ট্র্যাজিক রস ক্ষুণ্ন হয়েছে।
যদিও কৃষ্ণকুমারীর মৃত্যুর সঙ্গে ভার্জিনিয়া, ইফিগেনিয়ার মৃত্যুর সঙ্গে তুলনা করেছেন, সেখানে আমরা দেখেছি আলিউসের সঙ্গে প্রণয়কেন্দ্রিক জটিলতায় ভার্জিনিয়া নিজের মর্যাদা, সতীত্ব রক্ষার জন্য পিতার হাতে চুরি তুলে দিয়ে তাকে হত্যা করতে অনুরোধ জানায়। ভার্জিনিউস তখন কন্যা ভার্জিনিয়াকে হত্যা করেন। এছাড়াও এমিলিয়া নাটকে বাবা ও ডোবাড়ো কন্যা এমিলিয়াকে হত্যা করেন। তবে এই চরিত্রগুলির সঙ্গে আদলে কৃষ্ণকুমারী চরিত্রটির পরিকল্পনা করা হলেও কৃষ্ণকুমারী চরিত্রের মধ্যে গভীর ট্র্যাজিক তথা বেদনার স্ফুরণ ঘটেনি। বরং কৃষ্ণকুমারীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পিতা ভীমসিংহের হৃদয়ে যে গভীর হতাশা ও ব্যঞ্জনার সৃষ্টি হয়েছে এবং কন্যাকে হারিয়ে নিঃসঙ্গ পিতা শোকে মৃত্যু মুখে পতিত হয়েছেন।
সেই ঘটনাই পাঠক হৃদয়কে সবচেয়ে বেশি ব্যথিত করেছে। অতএব, একথা বলা যায় যে, ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকের কৃষ্ণকুমারীর মৃত্যুই ট্র্যাজেডির প্রধান অবলম্বন। কৃষ্ণকুমারী দেশের জন্য, জাতির জন্য আত্ম বিসর্জন দিয়ে মৃত্যুঞ্জয়ী হয়েছে, জীবনের পরম মহত্বের জয় ঘোষণা করেছে। কিন্তু এই মৃত্যু নাট্যকাহিনির গতিকে মন্থর করে দিয়েছে এবং ভীমসিংহকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়েছে। ফলে ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকের ট্র্যাজেডির বীজ কৃষ্ণকুমারী রোপণ করলেও সেই বীজ বা ট্র্যাজেডি পূর্ণতা পেয়েছে ভীমসিংহের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। আর মানসিংহ, জগৎসিংহ, ধনদাস, মদনিকা ও বিলাসবতী এরা প্রত্যেকেই সেই ট্র্যাজেডির সহায়ক।