মাইকেল মধুসূদনের কৃষ্ণকুমারী নাটকটি ট্র্যাজেডি নাটক হিসেবে সার্থক কিনা যুক্তিযুক্ত আলোচনা কর ?
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা নাটকের সূচনালগ্নে বিয়োগান্ত নাটক ও লেখা চলচ্ছিল। ১৮৫২ খ্রীঃ জি. সি. গুপ্ত ‘কীর্তিবিলাস’ নামে একটি বিয়োগান্ত নাটক রচনার প্রচেষ্টা করেন। তবে য়োরোপীয় নাট্যসাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় হবার পর থেকে বাংলায় বিয়োগান্ত নাটক লেখা শুরু হয়। ১৮৫৬ সালে প্রকাশিত উমেশচন্দ্র মিত্রের ‘বিধবাবিবাহ’ ভূমিকায় রয়েছে – ‘বিধবাবিবাহ নাটক is the first attempt made to introduce the regular tragedy in to Bengalee drama’ এভাবে এগিয়ে চলতে চলতে বিয়োগান্ত নাটকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে বাঙালি সমাজের। ১৮৬১ খ্রীঃ প্রকাশিত হয় আরেকটি বিয়োগান্ত নাটক ‘কৃষ্ণকুমারী’।
মানুষ যে সব দুঃখ দুর্দশা ভোগ করে তারজন্য দায়ী তার নিজের কর্মফল – একথা মেনে নিলে ট্র্যাজেডির মূল শিল্পভাবনাকেই অস্বীকার করা হয়, কারণ যে দুর্ভাগ্যের জন্য মানুষ নিজে দায়ী নয় সেই দুর্ভাগ্য ও শোচনীয় পরিণাম থেকেই ট্র্যাজিক শিল্প রচিত হয়। ট্র্যাজেডির মূল সত্য নির্দেশ করেছেন এরিষ্টটল। তাঁর মতে অপ্রাপ্য ভাগ্য বিপর্যয়ই ট্র্যাজেডির মূলকথা। কারণ এই জাতীয় ভাগ্য বিপর্যয় যে করুণা ও ভীতির জন্ম দেয় দর্শক মনে, তা থেকে ট্র্যাজিক রসসংবেদন ঘটে থাকে।
কৃষ্ণকুমারী নাটকের ট্র্যাজেডি
ট্র্যাজেডি বিচার প্রসঙ্গে দুধরণের ট্র্যাজেডির রীতি দেখতে পাই – প্রথমতঃ সেক্সপীয়রীয় ট্র্যাজেডির আদর্শ, দ্বিতীয়তঃ গ্রীক ট্র্যাজেডির আদর্শ। সেক্সপীয়রীয় আদর্শানুযায়ী প্রধান চরিত্রের যে দুঃখভোগ দেখা যায় তার জন্য দায়ী চরিত্র নিজেই। তার জীবনে অন্যকেউ এই দুর্ভাগ্য নিয়ে আসে না। নিজের অন্তর্নিহিত চারিত্রিক দুর্বলতা বা বিচার বিভ্রমের ফলে তার জীবনে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে গ্রীক ট্র্যাজেডিতে চরিত্র তাঁর নিজের পতনের জন্য দায়ী নয়, নিয়তির খেলায় তাঁর জীবনে পতন ঘটে।
মধুসূদন সেক্সপীয়র ট্র্যাজেজির কথা বারবার বলেছেন। যদি কৃষ্ণকুমারী নাটককে ট্র্যাজেডি বলা যায় তাহলে গ্রীক ট্র্যাজেডির সঙ্গেই তার সাদৃশ্য বেশি। মৃত্যু বেদনাদায়ক কিন্তু কখনও মৃত্যু আশীর্বাদে পরিণত হয়। হ্যামলেট নাটকে হ্যামলেটের উক্তি মৃত্যুর চরম কারুণ্য প্রকাশিত হয় –
Absent thee from felicity a while
And in this harsh world draw, thy
breath in pain,
To tell my story.
কিন্তু ‘কিংলীয়র’ নাটকে লীয়র যে মৃত্যুবরণ করেছেন তাকে বলা যেতে পারে তাঁর কাছে আশীর্বাদের মত।
কৃষ্ণকুমারী নাটকে কৃষ্ণার মৃত্যু করুণ এ বিষয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু সে মৃত্যু যদি পরিস্থিতির জটিলতায় এক অসহায় অবলুপ্তি হিসেবে দেখানো হত তবে তা করুণতর হতে পারতো। নাট্যকার কৃষ্ণার মৃত্যুকে মহিমাময় করে তোলার জন্য দেশাত্মবোধের অনুভূতি জড়িয়ে দিয়েছেন। কৃষ্ণকুমারীর মা অহল্যাবাঈও নাটকে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুকে আমাদের করুণ বলে মনে হয় না, কারণ প্রিয় কন্যার আত্মহননের দুঃখ তাঁকে সহ্য করতে হয়নি, অন্যদিকে ভীমসিংহ কৃষ্ণা জীবিত থাকতেই উন্মত্তের মত আচরণ করেছেন এবং কৃষ্ণার মৃত্যুর পর তিনি উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন একথা স্মরণে রেখে ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকে ট্র্যাজিক সংবেদনের কেন্দ্রীয় চরিত্র তাঁকে বলতে হবে।
Related কৃষ্ণকুমারী চরিত্র অথবা কৃষ্ণকুমারী চরিত্রের ট্র্যাজেডি আলোচনা কর।
ভীমসিংহের জীবনে যে শোচনীয় ভাগ্যবিপর্যয় দেখা দিয়েছে, তাঁর নিজের কোনো অন্তর্নিহিত ত্রুটি বা দুর্বলতা এর জন্য দায়ী নয়। তিনি হীনবল, দেশের ভেতরে ও বাইরে থেকে যে প্রবল আঘাত প্রতিনিয়ত পেয়েছেন তাতে তিনি প্রায় বিপর্যস্ত। তবু এমন কোনো ত্রুটি তিনি তাঁর চরিত্রে লালন করেননি যার জন্য তাঁকে কন্যার এই আত্মহননের শোক সহ্য করতে হবে। তাঁর বিচিত্র বিভ্রম এই ভয়াবহ পরিণতির জন্য দায়ী, তা বলা যুক্তি সংগত নয়। কৃষ্ণার মৃত্যুর সিদ্ধান্ত তিনি গ্রহণ করেননি, অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির চিঠিতে এ প্রস্তাব এসেছিল। অন্যদিকে গ্রীক ট্র্যাজেডির মূল কথা মানুষের পরিণতি হবে পূর্বনির্দিষ্ট। ভীমসিংহও নিজেকে ভাগ্যের হাতে সমর্পণ করেছেন। শেষ পর্যন্ত সেই নিয়তিই এই নাটককে নিয়ন্ত্রিত করেছে।
গ্রীক ট্র্যাজেডির সঙ্গে কৃষ্ণকুমারীর সাদৃশ্য থাকলেও ট্র্যাজেডি নায়ক হিসেবে ভীমসিংহ এতই দুর্বল যে তাঁর দুর্দশার চিত্র সঠিকভাবে আমাদের মধ্যে ট্র্যাজিক সংবেদন সৃষ্টি করতে পারে না। ভীমসিংহের ভাগ্য বিপর্যয় আমাদের দুঃখী করলেও ট্র্যাজেডির ইস্পিত ‘pity and fear’ জাগাতে পারেনা। তাই ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকে ট্র্যাজেডির মোটামুটি সার্থক পরিকল্পনা থাকলেও চরিত্র চিত্রণে আংশিক ব্যর্থতার জন্য সার্থক ট্র্যাজেডি হয়ে উঠতে পারেনি বলেই চিন্তাশীল সমালোচকের মনে হবে।