‘বড়বাজার’ রচনায় ‘বিদ্যার বাজার’ ও সাহেবদের ‘এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্স’-এর দোকানে গিয়ে কমলাকান্ত চক্রবর্তী তাঁর অভিজ্ঞতার যে সরস বর্ণনা দিয়েছেন তা নিজের ভাষায় বিস্তৃত কর।
একদিন কমলাকান্ত আফিমের মাত্রা চড়ালো। তাতে তার জ্ঞাননেত্র ফুটল এবং দেখতে পেল সুবিস্তৃত ভবের বাজার। দেখতে পেল অসংখ্য দোকানদার দোকান সাজিয়ে বসে আছে আর অসংখ্য ক্রেতা ক্রয় করছে।
কমলাকান্ত প্রথমে গেল রূপের বাজারে। তারপর রূপের বাজার ছেড়ে বিদ্যার বাজারে ঢুকল। গিয়ে দেখল বিদ্যার বাজারে ফলমূল বিক্রি হচ্ছে। এককোনায় গিয়ে দেখল কয়েকজন ফোঁটা-কাটা টিকিওয়ালা ব্রাহ্মণ তসর গরদ পরে নামাবলি গায়ে ঝুনা নারকেলের দোকান খুলে খদ্দের ডাকছে। তারা বলছে তারা ঘটত্ব পটত্ব ষ-ত্ব ণ-ত্ব বিক্রি করছে।
বিক্রেতারা বলছে ঘরে চাল থাকলেই স্ব-ত্ব না থাকলে ন-ত্ব। অভাব নামক নারকেল চার প্রকার, যথা
(১) অন্যোন্যাভাব–কমলাকান্ত বলছে— পরের ঘরে অভাব নেই কিন্তু নিজের আছে। এটিকেই বলা হচ্ছে অন্যোন্যাভাব।
(২) প্রাগভাব—যতক্ষণ ধন নেই ততক্ষণ প্রাগভাব।
(৩) ধ্বংসাভাব – ধন নষ্ট হলে ধ্বংসাভাব।
(৪) অত্যন্তাভাব— দরিদ্র মানুষের ঘরে সর্বদাই অভাব। কমলাকান্ত একেই বলছে অত্যন্তাভাব।
ন্যায়শাস্ত্রের চতুর্বিধ অভাবকেই কমলাকান্ত দরিদ্রের অভাবের সঙ্গে মিলিয়ে wit সৃষ্টি করেছে। ব্রাহ্মণরা কমলাকান্তকে বলছে টাকা দিলেই কার্য হবে। টাকা কম দিলে অকার্য। যদি কমলাকান্ত নারকেল না কেনে তবে বিক্রেতা এই ঝুনো নারকেল মাথায় ঠুকে মরবে।
কমলাকান্ত বলল—ঝুনো নারকেল কিনতে তার আপত্তি নেই, তবে নারকেল ছুলবার জন্য দা-এর প্রয়োজন। বিক্রেতা ব্রাহ্মণেরা বলল তারা ছোলে না, কামড়ে নারকেলের ছোবড়াটুকুই খায়; অর্থাৎ তারা যে বিদ্যা দান করে তার নীরস কঠিন অংশটুকুই শুধু ছাত্ররা খায়। বিদ্যার রসের অংশ আনন্দের অংশটুকু ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা দিতে পারে না।
কমলাকান্তের এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের দোকানের অভিজ্ঞতা
কমলাকান্ত গেল এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের দোকানে। এখানে ঝুনো নারকেল, বাদাম, পেস্তা, সুপুরি প্রভৃতি ফল বিক্রি করছে সাহেব দোকানি।
Read also কমলাকান্তের দপ্তর’-এর হাস্যরস
দোকানঘরের উপর লেখা আছে বিক্রেতার নাম—মেসার্স ব্রাউন জোনস অ্যান্ড রবিনসন। নাট সাপ্লায়ার–১৭৫৭ সালে পলাশীতে স্থাপিত। এখানে কমলাকান্ত ইংরেজরা পলাশীর যুদ্ধে জয়ী হয়ে তাদের সাম্রাজ্য স্থাপন করে ব্যবসায় চালাচ্ছে সেই কথা বলছে। তাদের উদ্দেশ্যই হচ্ছে। ভারতীয় যুবকদের দাঁত ভেঙে দেওয়া অর্থাৎ অত্যাচার করা। তারা বলছে—“আয় কালা বালক Experimental Science খাবি আয়।” এই দোকানে বিনামূল্যে ঘুঁষি দিয়ে ছাত্রদের দাঁত মাথা এবং হাড় ভেঙে দেওয়া হয়। পরের মাথা এবং নরম হাড়’-এর উপরেই তাদের তথাকথিত পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান প্রয়োগ করা হয়; অর্থাৎ তারা দুর্বল ভারতীয়দের উপর বলপ্রয়োগ করে। দুর্বলের উপর অত্যাচার করে।
দোকানদার ভারতীয়দের চুল টেনে ধরাতে পারদর্শী। কালা আদমিদের পিঠে তারা মুষ্টিপ্রহার করে। তারা বলছে অগ্রিম দাম দিলে চ্যারিটিতে এক্সপেরিমেন্ট খেতে পারবে। এখানেও একটা বিদ্রূপ আছে। চ্যারিটি মানে বিনামূল্যে কোন দ্রব্য বা সেবা বিতরণ। এখানে ইংরেজরা বলছে দাম দিলে চ্যারিটিতে দেওয়া হবে। এটাও একটা বিদ্রূপ কমলাকান্তের; অর্থাৎ ইংরেজ ভারতবাসীকে যা দিচ্ছে তার মূল্য পরোক্ষভাবে করের মাধ্যমে আগেই দিচ্ছে। তার বদলে ইংরেজ দিচ্ছে শুধুই অত্যাচার। আর চ্যারিটিতে নানান সেবার কথা প্রচার করে।
Related কমলাকান্তের দপ্তর একটি গীত
এমন সময় কমলাকান্ত দেখল ইংরেজ দোকানদারেরা ব্রাহ্মণদের ঝুনা নারকেলের দোকানের ব্রাহ্মণ দোকানদারদের উপরে লাঠি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তখন ইংরেজরা পরিত্যক্ত নারকেলগুলি এনে ‘বিলাতি অস্ত্রে ছেদন করে’ সুখে আহার করতে লাগল; অর্থাৎ ভারতীয় সংস্কৃত সাহিত্যকে ব্যাকরণের কচকচি থেকে উদ্ধার করে ইয়োরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে আলোচনা করে সকলের কাছে উপাদেয় করল। এই পদ্ধতির ইংরেজরা নাম দিয়েছে ‘এশিয়াটিক রিসার্চ’। অবশ্য এই কথাও সত্যি যে ইংরেজরা সংস্কৃত সাহিত্যকে সকলের কাছে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।
এই দুই বাজার, ফলের বাজার এবং এক্সপেরিমেন্টাল বিজ্ঞানের বাজার, নিয়ে কমলাকান্তের বিবরণে যথেষ্ট পরিমাণ হাস্যরস এবং উইট আছে। আছে ব্যথাবেদনা। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের ন্যায়শাস্ত্র কপচানো এবং সাংসারিক অভাব নিয়ে হাস্যরসের আড়ালে কমলাকান্তের বেদনার দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়। ইংরেজদের অত্যাচারকেও ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে অর্থাৎ পলাশির যুদ্ধ জয় থেকে এই অত্যাচারের শুরু এই কথাই বলা হয়েছে।
কমলাকান্তের জবানিতে হাস্যরসের মাধ্যমে এই বর্ণনার গভীরতা পাঠককে বিষাদাচ্ছন্ন করে।