শ্রীকান্ত উপন্যাসে- “চোখের উপর যেন স্পষ্ট দেখিতে পাইলাম, পিয়ারী দীপের সম্মুখে অধীর আগ্রহে সজল চক্ষে বসিয়া প্রতীক্ষা করিয়া আছে, ..” উক্তিটি কার
- উক্তিটি শ্রীকান্তর।
- পিয়ারীর প্রকৃত নাম রাজলক্ষ্মী।
- পিয়ারীর ভৃত্যের নাম রতন।
উদ্ধৃত উক্তিটির বক্তা হল উপন্যাসের নায়ক শ্রীকান্ত।
শ্রীকান্ত উপন্যাসের শ্রীকান্ত চরিত্র
শ্রীকান্ত উপন্যাসের প্রধান চরিত্র একজন ভবঘুরে। শ্রীকান্তের কেউ নেই। পিসিমার বাড়িতে তাঁরই আশ্রয়ে কেটেছে শ্রীকান্তের কৈশোর। সেখানে মেজদার তত্ত্বাবধানে লেখাপড়া করত। এই মেজদা আবার দু-দুবার ফেল। এখানেই পরিচয় হয় ডাকাবুকো, অসীম সাহসী ইন্দ্রনাথের সঙ্গে। ইন্দ্রনাথ তাকে মাছ চুরি করতে নিয়ে যায়। শ্রীকান্তও ভয়ডরহীন বেপরোয়া দুঃসাহসিক প্রকৃতির ছেলে। এ ব্যাপারে তার গুরু হল ইন্দ্রনাথ। মাছ চুরির ঘটনাটি সে উপভোগ করে, কিন্তু যখনই অর্থের লেনদেনের ঘটনা তার নজরে পড়ে তখনই সে সিঁটিয়ে যায়।
শ্রীকান্ত ঠিক আদর্শবাদী নয়। তবে তারও একটা রয়েছে নিজস্ব মূল্যবোধ। তার কাছে টাকা চুরিই চুরি। অন্য চুরি চুরি নয়। শ্রীকান্ত নিজের সম্পর্কে বলছে— “যৌবনের তেজ এবং দৃঢ়তা না আসুক, তাহলে দম্ভ ত তখন আসিয়া হাজির হইয়াছে। …তখন সঙ্গীর কাছে ভীরু বলিয়া কে নিজেকে প্রতিপন্ন করিতে চাহে।”
শ্রীকান্তের মনের মধ্যে একটা শিশুসুলভ মূল্যবোধ এবং কিশোরসুলভ সাহসী সাজবার মানসিকতা লক্ষ করা যায়।
শ্রীকান্ত একজন সংবেদনশীল মানুষ। কৈশোর থেকেই তার মনটা দয়ার্দ্র। নতুনদা তাকে নানাভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছিল। তাতে শ্রীকান্তের অন্তত নতুনদার প্রতি সহানুভূতি বা ভালোবাসা থাকবার কথা নয়। নতুনদার জন্য আহার্য সংগ্রহ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার পর তাকে নৌকায় না দেখে ইন্দ্রনাথ এবং শ্রীকান্ত ভয় ছেয়ে গেল। নতুনদাকে সম্ভবত বাঘে নিয়ে গেছে—ইন্দ্রনাথ এই আশঙ্কা প্রকাশ করা মাত্র তার মনোভাব–“সে কি কথা! ইতিপূর্বে তাঁহার নিরতিশয় অভদ্র ব্যবহারে আমি কুপিত হইয়া উঠিয়াছিলাম সত্য, কিন্তু এত বড় অভিশাপও দিই নাই।”
শ্রীকান্ত বন্দুক চালানোয় দক্ষ হয়েছে যৌবনে। কিন্তু ক্ষুদ্র অসহায় পাখি শিকারে তার অনীহা। এসব ঘটনা থেকে তার করুণামাখা হৃদয়ের সন্ধান পাই আমরা।
গৌরী তিওয়ারির কন্যার ব্যাপারেও সমাজের নিষ্ঠুর বিধি-বিধানের প্রতি শ্রীকান্তের বিরূপতা এবং মেয়েটির প্রতি সহানুভূতি আমরা লক্ষ করি। আবার অন্যদিকে তার নির্ভীক দুঃসাহসী দিকটাও দেখি রাত্রিবেলা মহাশ্মশানে বসে থাকার ঘটনায়। যদিও ইন্দ্রনাথের মতো ভূত এবং রামনামে বিশ্বাসী নয়, তবু সে নিজের মতোই ভয়হীন।
শ্রীকান্ত একজন ভবঘুরে, কিন্তু প্রেমিক। সমাজের চোখ দিয়ে ভালোমন্দের পরিমাপ করে না। সে নিজের অন্তরের আলোকে মানুষকে বিচার করে। তাই বাল্যপ্রেমিকা রাজলক্ষ্মীকে পিয়ারীবাইজী রূপে কুমার বাহাদুরের তাঁবুতে দেখতে পেয়েও তাকে ঘৃণা করেনি শ্রীকান্ত। রাজলক্ষ্মীকে প্রেমময় নারীর মতোই দেখেছে। এইখানেই সমাজপতির দৃষ্টি থেকে শ্রীকান্তের দৃষ্টির পার্থক্য বোঝা যায়। সে মানুষকে মানবতা দিয়েই বিচার করতে চায়।
শ্রীকান্ত সাধুর চেলা হয়ে যায়। আবার বিপন্ন রামবাবুর জন্য সাধুর সংস্রব অনায়াসেই ত্যাগ করে। এইসব গুণাবলির জন্য শ্রীকান্ত-চরিত্র পাঠকের মনে বিস্ময়ের সঞ্চার করে এবং আমাদের সকলের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে।