কমলাকান্তের দপ্তর একা ‘কে গায় ওই’?
একদিন জ্যোৎস্না রাত্রে এক পথিকের গান কমলাকান্তের কানে প্রবেশ করল। *কমলাকান্ত সেই সংগীত শুনে মুগ্ধ হল। ঐ গান যে খুব সুন্দর তা নয় কিন্তু গায়কের কণ্ঠস্বরের মাধুর্য কমলাকান্তের হৃদয়কে আলোড়িত করল কেন?
এই কেনর কোন উত্তর নেই। জ্যোৎস্নাময়ী রাত্রি, নদীর পারে জ্যোৎস্না যেন হাসছে। রাজপথে বালক-বালিকা যুবক-যুবতী প্রৌঢ়া এবং বৃদ্ধারা আনন্দ করছে— এই সময় শুধু কমলাকান্তের মনেই আনন্দ নেই। কারণ কমলাকান্ত একা। এই নগরে, এই আনন্দময় জনস্রোতে, কমলাকান্ত একা। বিন্দু বিন্দু বারিতে সমুদ্র গঠিত। কমলাকান্তরূপ বারিবিন্দু এই জনসমুদ্রে মিশতে পারে না কেন। কমলাকান্ত কারণ জানে না, শুধু এইটুকু জানে যে সে একা। সে পরের জন্য এই হৃদয়কে বিলিয়ে দেয় যেন।
Read more কমলাকান্তের দপ্তর একটি গীত
কমলাকান্ত অনেকদিন আনন্দসংগীত শোনেনি। অনেকদিন আনন্দানুভব করেনি। তাই এই গান তার কাছে এত মধুর মনে হল। যৌবনে কমলাকান্ত সবকিছুর মধ্যে সৌন্দর্য অনুভব করত। তখন তার মনে আনন্দ ছিল। পৃথিবী একই রকম আছে, কিন্তু দ্রষ্টার হৃদয়ের পরিবর্তন ঘটেছে। তখন গান শুনলে আনন্দ হত। আজ পথিকের এই গান শুনে তখনকার গানের কথা মনে পড়ল। এই গান শুনে কমলাকান্ত যেন যৌবন ফিরে পেল। সেই বন্ধুমণ্ডলীর মধ্যে বসার সুখ সেই অকারণ হাসি মনে পড়ল। কমলাকান্তের মনে ক্ষণিক ভ্রান্তি জন্মেছে বলেই এই গান এত মধুর মনে হল আজ।
সেই প্রফুল্লতা সেই আনন্দ আজ আর নেই কেন। লাভ-ক্ষতি এই জগতের নিয়ম। তবে ক্ষতি অপেক্ষা লাভ বেশি। তবুও বয়স হলে আনন্দ কমে যায়। পৃথিবীর সকল সুন্দর জিনিষের সৌন্দর্য কম বলে মনে হয়। তার কারণ যৌবনে আশা থাকে। আশা হল রঙিন কাচ, যার ভিতর দিয়ে দেখলে সব কিছুই রঙিন বলে মনে হয়। বয়স হলে সেই আশা অদৃশ্য হয়ে যায়। এখন কমলাকান্ত জানতে পেরেছে এই সংসারচক্রে করে যেখানকার সেখানেই ফিরে আসতে হবে।
Related ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর হাস্যরস
এখন মনে হয় এই অরণ্যে কোন পথ নেই, এই প্রান্তরে জলাশয় নেই, এই নদীর কূল নেই, এই সাগরে দ্বীপ নেই, এই অন্ধকার সংসারে নক্ষত্রের আলো নেই। এই বয়সে বোঝা যায় সংসারের সমস্ত সৌন্দর্যের মধ্যে মন্দ জিনিস বর্তমান। মানুষ কেবল নিজেকেই আদর করে। নিজের কথাই ভাবে। এই সংসারে কাচ হিরার ন্যায়। উজ্জ্বল পিতলের রঙ সোনার মতোই ভাস্বর, পঙ্ক চন্দনেরই মতো স্নিগ্ধ।
কমলাকান্তের সেই গীতধ্বনির কথা মনে পড়ল। এই প্রসঙ্গে বলছে সংসারেরও একটা সংগীত আছে, যে সংগীত কেবলমাত্র সংসার রসিকেরাই শুনতে পায়। সেই সংগীত শোনার জন্যই কমলাকান্ত আকুল। সে হয়তো সংসার সংগীত শুনতে পাবে কিন্তু পূর্বে শ্রুত সেই সংগীত শুনতে পাবে না। কিন্তু তার পরিবর্তে সে শুনতে চায় প্রীতি ও প্রেমের সংগীত। ঈশ্বরই প্রীতি। মনুষ্যজাতির উপর যদি প্রীতি থাকে তবে তিনি অন্য সুখ চান না।