Bengali

‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর হাস্যরস

‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর হাস্যরস

হাস্যরসকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে; যথা—Humour, Wit এবং Satire | Humour বিশুদ্ধ হাস্যরস। এখানে বুদ্ধির খেলা কম, হৃদয়ের স্নেহই অধিক। হিউমারের উদ্দেশ্য কাউকে আঘাত করা নয় কোমল একটা অনুভূতি মিশ্রিত করে স্নেহকে জাগিয়ে তোলা। উইট (Wit) কিন্তু সেরকম নয়। উইট হচ্ছে বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরস। বুদ্ধিজাত এই হাস্যরসের প্রকৃতি খানিকটা উচ্চাঙ্গের। শাণিত তরবারির মতো ঝলসে উঠে শ্রোতা বা পাঠকের মন উজ্জ্বল করে তোলে। Satire বা ব্যঙ্গ সেই ধরনের নয়। শ্লেষ মিশ্রিত সুতীব্র ব্যঙ্গের উদ্দেশ্য হল আঘাত করা। রবীন্দ্রনাথের রচনায় বিশুদ্ধ হাস্যরস বা হিউমার যত্রতত্র ছড়িয়ে আছে। অবশ্য Wit-এর অংশ কম নেই। ব্যঙ্গ বা Satire এও রবীন্দ্রনাথ সিদ্ধহস্ত।

কমলাকান্তের দপ্তরে হাস্যরস

কমলাকান্তের দপ্তর হাস্যরসাশ্রিত রচনা। এতে হিউমার উইট এবং ব্যঙ্গ প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়। Humour রচয়িতা জীবনের নানারূপ অসঙ্গতি প্রকাশ করে নির্মল হাস্যরস প্রকাশ করেন। Wit-এর রচয়িতাও একটি শ্লেষের সাহায্যে, একটি বুদ্ধিদীপ্ত বাক্যের সাহায্যে অসঙ্গতিকে প্রকাশ করেন। হিউমার এবং উইটের নিকট সম্পর্ক আছে। তবে উঁচুদরের হিউমারে উইটের একান্ত প্রয়োজন। হাস্য এবং ব্যঙ্গের মূল উদ্দেশ্যই হল জীবনের অসঙ্গতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা। স্যাটায়ারের উদ্দেশ্য হল সুতীব্র কশাঘাতে সংশোধনের চেষ্টা করা। স্যাট্যায়ারের মূল উদ্দেশ্য হল আঘাত করা।

Read more কমলাকান্তের দপ্তর একা ‘কে গায় ওই’?

‘একা কে গায় ওই’ রচনার নামকরণ থেকেই এর মধ্যেকার কান্না ও হাহাকার শুনতে পাই। এই রচনা গদ্যের ছদ্মবেশে কবিতার, দুঃখের অশ্রু দিয়ে রচিত হয়েছে। যেখানে লেখক বলছেন—“পৃথিবী এখনো তাই আছে, সংসার এখনও তাই আছে, মনুষ্যচরিত্র এখনও তাই আছে। কিন্তু এ হৃদয় আর তাই নাই।” অথবা “এখন জানিয়াছি যে, এ অরণ্যে পথ নাই, এ প্রান্তরে জলাশয় নাই, এ নদীর পার নাই, এ সাগরে দ্বীপ নাই, এ অন্ধকারে নক্ষত্র নাই।” এখানেও তো কান্না, দীর্ঘশ্বাস এবং হাহাকার শুনি।

‘একটি গীত’-এও তাই। এখানে প্রতিটি ছত্র বিষাদ মাখানো। অম্ল-মধুর হাসির

আড়ালে বঙ্কিমচন্দ্রের বিষাদ প্রতিমা, দুঃখের অশ্রু, দেখা যায়। বুদ্ধিদীপ্ত উইটের

ফাঁকে ফাঁকে বঙ্কিমের সহানুভূতির করুণ অন্তরকে খুঁজে পান পাঠকেরা। ‘আমার দুর্গোৎসব’ তো অশ্রুর কালিতে লেখা রচনা। “এসো, ভাই সকল? আমরা অন্ধকারে কালস্রোতে ঝাঁপ দিই। এসো আমরা দ্বাদশ কোটি ভুজে ঐ প্রতিমা তুলিয়া, ছয় কোটি মাথায় বহিয়া, ঘরে আনি।” কালগর্ভে নিহিতা সুবর্ণময়ী বঙ্গ-প্রতিমার জন্যই কাঁদছেন। এই কান্না দেশের জন্য বঙ্গভূমির জন্য বাঙালি কবির পতন ও দুঃখের জন্য।

See more কমলাকান্তের দপ্তর একটি গীত

আমাদের মনে হয় ‘বড়বাজার’-এও ব্যঙ্গের আড়ালে বঙ্কিমের দুঃখিত মুখ দেখা যায়। বাংলা বই সম্পর্কে যা বলেছেন তাতো দুঃখ থেকেই বলছেন। ফোঁটা টিকিওয়ালা ব্রাহ্মণেরা যা বিক্রি করছে—অর্থাৎ সংস্কৃতের নামে শুধুই শুষ্ক ব্যাকরণ। সংস্কৃত সাহিত্যের প্রকৃত রস পাঠকেরা পাচ্ছেন না। সাহেবদের হাতে পড়ে তাই হয়ে উঠেছে সুস্বাদু। সংস্কৃত সাহিত্যের স্বাদ তারাই চাখছেন। এখানেও তো দুঃখই প্রকাশ করছেন তিনি হাসির আড়ালে। স্বদেশিয় সংস্কৃত চিন্তা এবং সাহেবিয় চিন্তার পার্থক্য দেখে আপাত হাসি হাসছেন বটে—কিন্তু ছত্রে ছত্রে বিষাদেরই প্রকাশ।

কমলাকান্তের দপ্তরে বিশেষ করে মনুষ্যফল এবং বড়বাজার এই দুটি রচনায় তিনরকম হাস্যরসের নিদর্শন দেখা যায়। যদিও আপাতদৃষ্টিতে এগুলি হাস্যরস কিন্তু আসলে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিকে আলোকপাত করেছেন লেখক। ফলে হাস্যরস শেষপর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে জীবন রহস্যে।

Related কমলাকান্তের দপ্তর বড়বাজার

‘বসন্তের কোকিল’-এ নসীবাবুর সুখের দিনে মানুষ কোকিলের ব্যবহার এবং একই মানুষেরা নসীবাবুর দুঃখের দিনে তাদের অন্য রকম রূপ আপাতদৃষ্টিতে হাসির হলেও মানব চরিত্রের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করছে। লেখকের অন্তর্দৃষ্টি মনুষ্যচরিত্রকে পরিস্ফুট করছে। ‘মনুষ্যফল’ নিবন্ধে দেশি হাকিমের সঙ্গে কুষ্মাণ্ডের তুলনা হাস্যোদ্রেক করে কিন্তু একই সঙ্গে দেশি হাকিমদের প্রকৃত অবস্থার প্রতি মর্মভেদী কটাক্ষ হয়ে উঠে এই মন্তব্য। তাই হিউমারকে ছাপিয়ে স্যাটায়ারের রস পাওয়া যায়।

কমলাকান্তের দপ্তরে স্বদেশ চিন্তা, দার্শনিক তত্ত্ব এবং জীবন দর্শনমূলক রচনা, সমাজ বিশ্লেষণমূলক রচনা, কবিত্ব সবই আছে তাতে মাঝে মধ্যে হিউমার, উইট এবং স্যাটায়ারের ফোড়ন দেওয়া। তবে মননধর্মী ব্যঙ্গ রচনাগুলো যাতে পুরোপুরি ব্যঙ্গের আস্বাদ পাওয়া যায় তা হল মনুষ্যফল ও বড়বাজার।

Back to top button

Adblock Detected

If you enjoy our content please support our site by disabling your adblocker. We depend on ad revenue to keep creating quality content for you to enjoy for free.